মৎস্য-পুরাণ

গ ল্প
ওয়াহিদ সুজন


এক.
আমার জন্ম নদীতে। একদিন চোখ খুলে দেখি, নদীর জলে আমি ভেসে আছি। সাঁতরে তীরে উঠে গেলাম। আমার ভাই বোনেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এছাড়া মৎস্যজীবন শুরুর কোনো স্মৃতি অটুট রইল না।

আমি যখন নদীর তীর ধরে হাঁটি আমার ভাই-বোনেরা নদীর জলে জেগে ওঠে। আমি নদীতে ঝাঁপ দিই। তাদের সাথে সাঁতার কাটি, খেলা করি। জলের জীবনে কোনো কান্তি নাই। কেমন যেন ভরশূন্য অনুভূতি। কখন যে আমার ভাই বোনদের সাথে পাখি হয়ে উঠি আমি নিজেও জানি না। মাঝে মাঝে আমার মাছ মাকে দেখতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ওরা বলে নদীই আমার মা। হয়তো কোনো এক ধরনের ঠাট্টা। আমি সেই ঠাট্টা বুঝি না।

একদিন আমার এক ভাইকে মাছরাঙা পাখি তুলে নিয়ে গেলো। অন্যরা পালিয়ে গেলো খুব দ্রুত । আমি চুপচাপ জলে ভাসতে থাকলাম। আমার চোখের জল নদীতে মিশে গেলো। সেখান থেকে একখানা কচুরিপানা তৈরী হলো। আমি তাজ্জব হয়ে ল্য করলাম, সেই পানা’তে কতদ্রুত একখানা সাদা ফুল ফুটল। আমি সেই ফুলের নাম দিলাম দুঃখফুল। এতো চমৎকার ফুলের নাম দুঃখ হয় কী করে?

ততণে আমার অন্য ভাই বোনেরা ফিরে  এসেছে। তারা যেন খেলার নতুন সঙ্গী পেলো। ফুলটি খুব সহজে ওদের সাথে মিশে গেলো। এই যে একটু আগে একটা ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেল, তা নিয়ে এদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। আমার মন আরো খারাপ হয়ে গেল। গা শিরশির করে উঠল, যদি না বিশাল কোনো পাখি এসে আমাকে টুপ করে তুলে নিয়ে যায়! আর এরা একটু পরেই আমাকে ভুলে যাবে। আমার অভিমান হয়। অচিন অভিমান।

আমি দেখতে পেলাম ফাঁদে পড়া একটা মাছরাঙা। হয়তো সেই মাছরাঙাটাই। সে ফাঁদ থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করছে। আমি তাকে ছেড়ে দিলাম। মাছরাঙাটি আমার ঘাড়ে এসে বসল। আমি তার নাম জিজ্ঞেস করলাম, অমনি পাখিটি উড়ে গেলো।

আমি আর কী করি? তেমন কিছু না। বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াই... আর সেই নদীর তীর ধরে হাঁটি। তার শুরু আর শেষ খুঁজি। কিন্তু উত্তর পাই না। মনে হয় সবকিছুই আমার রূপান্তরের মতো। দিক চিহৃহীন কুয়াশায় মিশে গেছে। অথচ আমি দেখি, আমার আশপাশের মানুষেরা দিব্যি বলে দেয়, তারা সবকিছু জানে। আর আমি শুধু জানি, আমি মানুষের খোলসে আবদ্ধ একখানা মাছ। এইজন্যই কি আমার সীমাবদ্ধতা? আমার মা’ কে এই কথা বললে সে কেমন যেন দুশ্চিন্তায় মুখ থমথমে করে ফেলে।
বাবা বলে, “এটা আর কি? বাচ্চাদের কল্পনা। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি বড় হতে চাই না, কী চমৎকার মৎস্য জীবন!
সুদূর কোনো এক কালে ছিলো এক রাজপুত্র । কী এক অভিশাপে সে ব্যাঙ হয়ে গেলো। যদি কোনো রাজকন্যা তাকে চুমু খায়, তবে সে আবার মনুষ্য জীবন ফিরে পাবে। আমার বাবার মুখে সব’ চে বেশি শোনা গল্প এটি। হয়তো আমার বাবা একটাই গল্প জানতেন।

সারারাত ঘুমোতে পারি না। যেন আমাকে নিয়ে এই গল্প। শুধু উল্টো করে বলা।
বাবাকে বলি, “এটা কি সম্ভব?”
তিনি হেসে বলেন, “রূপকথার জগতে সব সম্ভব। সে জগত তো সত্য নয়। তাই একে মিথ্যে বলা যায়।”
আমি প্রশ্ন করি, “মিথ্যে হলে সে গল্প আসলো কেমন করে? তুমি তো বলো, মিথ্যে বলা ঠিক না। যদি এমন হয় এই জগতটা মিথ্যে আর গল্পটা সত্য?”
বাবা অবাক হয়ে বলেন, “দারুন বলেছিস, জ্ঞানীদের মতো। এটা যদি সত্য হতো, তাহলে তা আমরা বুঝতে পারতাম।”

আমি বুঝতে পারি সেই গল্প মিথ্যে না, কিন্তু এই মনুষ্য জীবনও তো মিথ্যে না। আমি মাছেদের কথা বুঝি, বলতে পারি। অথচ অন্যেরা পারে না।
বাবা বলেন, “যা শুধুমাত্র একজনের জন্য সত্য, অন্যদের কাছে তার মূল্য খুব কম।”
আমি এই কম মূল্যবান সত্য নিয়ে দ্বৈত জীবন যাপন করি। উভচর জীবন।

দুই.
আমি আমার মাছ ভাই বোনদের জিজ্ঞেস করি, তারা কখনো আমাকে কোনো অভিশাপ দিয়েছে কিনা। তারা অভিশাপ বিষয়টা বুঝলোই না। বুঝি তারা আমার চে আলাদা কিছু। আমি আস্তে আস্তে সাঁতার কাটি। আমার পায়ে শ্যাওলা জড়িয়ে যায়।
আমি শ্যাওলাকে প্রশ্ন করি, “কেন এমন হয়?”
সে বলে, “জানি না। আমরা এতটুকু জানি, যা হবার হবে। আমি একখানা শ্যাওলা- হয়তো মাছে খাবে, নয়তো রোদে শুকিয়ে মরবো।”

এতো নির্লিপ্ততা আমার সহ্য হয় না। এরা এতো নির্লিপ্ত কেন? নিজের ভেতর কেমন যেন বিদ্রোহ টের পাই। দুটো জিনিস একইসাথে আমার ভেতর ঘর করে- তা হলো, আমার মনুষ্য সত্তা সকল কিছুতেই তার মহাজনী কায়েম করতে তৎপর। আবার অন্যদিকে ভাষাগত আর ভাবগতভাবে আমি মৎস্য জীবনে প্রবেশ করি কিন্তু আলাদা হয়েও তার অস্তিত্ব জোরালোভাবে কোন কিছু দাবী করে না, তারমধ্যে উদাসীনতা, তন্ময়তা খেলা করে, ধরে নিয়েছি এমন হয়। এরা যে, একই সাথে কথা বলে তা না, বরঙ মনুষ্য সত্তা নিজেকে প্রাণপণে জাহির করতে তৎপর। হয়তো কখনো বা আমি আমার মৎস্য সত্ত্বাকে জোরালো করতে চাই, কিন্তু সে এই বিরোধের ধারনাকে অগ্রাহ্য করে। এখন এই বিষয়টাকে ভ্রম মনে হয়। কেন যেন মনে হয়, মানুষ সবসময় বিরোধ খোজে- তাই সে ছলনার বসত গড়ে। নিজেকে জাহির করতে না পারলে সে ম্বস্থি পায় না।
হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, সবকিছুই ঠিক। জগতের কোনো মানুষ বৃ, কেউ পাখি, কেউ আবার মেঘ। কেউ বুঝতে পারে, আবার কেউ পারে না। আমি বুঝি, এই হলো জনারণ্যে মিশে যাবার ছল। এটা হলেই বা তাতে তো আমার দ্বৈতজীবনের হেরফের হয় না। আমি একবার খেয়ালের বশে বৃরে একখানা ডাল ভাঙ্গতে যাই।
কে যেন আর্তচিৎকার করে বলে, “এই বড়ো অকারণ।”
আমি কেমন যেন ছটফট করি, নিঃশ্বাস নিতে পারি না, সারা শরীর জ্বলতে থাকে। আমি নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পড়ি, জ্বালা জুড়োয়।
আমার ভাই-বোনেরা বলে, “এমন করতে হয় না।”
আরো বলে, “নিয়ম ভাঙ্গতে নেই।”
“কী সে নিয়ম?” তারা কোনো উত্তর দেয় না।

আমি নিজের ভেতর কারণ-অকারণের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ি। ভেতর বাইরে প্রচন্ড কান্তি ভর করে। মায়ের কোলে মাথা রাখি।
মা’কে বলি, “মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও।”
মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আহা, আমি যেন দখিনা হাওয়ার ভেতর সাঁতার কাটছি।

আমি স্বপ্ন দেখি, মৎস্য হয়ে ভেসে যাচ্ছি নদীর শেষ দেখব বলে। আমার পাশাপাশি আমার ভাই বোনেরা। আবার দেখি আমরা দল বেঁধে দখিনা হাওয়ার গান করছি আর উড়ে উড়ে তার উৎস খোঁজ করি। কী যেন একটা গান করি? ওহ, মনে পড়েছে।
“দখিনা হাওয়া, তোর বাড়ি কই। চেয়ে দেখ, জগতের তাবৎ পাখি তোর খোঁজে এসেছি উত্তর হতে, যেখানে মেঘ টইটুম্বর, খেলা করে খালে-বিলে।”
আবার দেখি, অনেক অনেক বৃরে মাঝে আমি একজন।
আমরা বলছি, “হে আমার অশ্র“ বিন্দু যা তুই উড়ে যা। আমার চিঠি পৌঁছে দিয়ে ফিরে আয় আকাশে।” আমাদের অশ্র“ উড়ে উড়ে সুনীল আকাশটাকে মেঘলা করে দেয়। এ যেন বৃরে দল উড়ে গেল আকাশে...

এবঙ
এখন আমি নিজেকে নিবিড় করে আর অনুভব করি না। নদী নামক ধূ ধূ বালু চরে বসে থাকি। কখনো কখনো ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো খাবি খাই। আমার মৎস্য সত্তা দিন দিন নিঃশেষ হয় নিজেতে। কখনো মনে হয় ঘ্রাণ শক্তি কমে গেছে। আগের মতো ফুলের তীব্র সুবাস হৃদয়ে কথা বলে ওঠে না। অনেক রঙ নিজেদের বৈচিত্র্যতা হারিয়ে ফেলেছে। চারপাশে বর্ণহীনতার খেলা।

আমি জেনে গেছি, মনুষ্যজীবনের অভিশাপ- সে ভয়ানক নিঃসঙ্গ। সব থেকেও তার কিছু নাই।

এই বালুচর একদিন ছিল আমার তীর্থ। সেদিন এই বালুচর ছিলো না, এখন বিশ্বাস হতে চায় না। সত্যি, সময় আজব ঘটনা। আর আমার ভাই-বোনদের সাথে শেষ দেখা...
আমি ভুলে যেতে চাই।

2 comments:

  1. vaia lekhatar plot khubi different.aghe porinei erokom lekha.

    kintu kichu kichu sobdo O bakko continuous mone hoy nai.hoyto eta vinno style hote pare.

    sorbopori valo legeche

    ReplyDelete
  2. ভাষাগত কিছু সমস্যা থাকতে পারে। আশা করছি বিষয়গুলো ভবিষ্যতে আরো স্পষ্ট হবে।
    বিষয়টি ধরিয়ে দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

    - ওয়াহিদ সুজন

    ReplyDelete

পাঠক সংখ্যা

free counters