ভালবাসার স্পর্শ

গ ল্প
আসমা সাদেকা

মা মারা গেলে বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছিলাম না কিছুতেই। নিজেকে বেশ একা মনে হচ্ছিল। খুব অল্প বয়সে মাকে হারিয়ে আমি অসহায় বোধ করলাম। আমার এই বিষণœতা বাবাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। বাবা আবার বিয়ে করেন। নতুন মাকে দেখে মনে হল আমি যেন মাকে ফিরে পেয়েছি আবার। মায়ের প্রতি ভালবাসার কমতি ছিল না আমার। তবে কখনো বুঝার বা ভাবার চেষ্টা করিনি মা আমাকে ভালবাসে কি না। ধীরে ধীরে সংসার বড় হল। বুঝতে পারি আমাকে সকলের বোঝা মনে হচ্ছে। মায়ের ভালবাসার মধ্যে কৃত্রিমতা আমি উপলব্ধি করতে থাকি। আমি তাদের যতই কাছের মনে করি না কেন আমাকে তারা আপনভাবে দেখেনি কখনো। মাকে ভালবেসেছি প্রচুর। আর ভাই বোনেরা ছিল আমার এক একটা অঙ্গ। কিন্তু আমাকে তারা আপন করে নেয়নি কখনো তা বুঝতেই পারলাম না কিছুতেই। তাদের ভালবেসে এতই অন্ধ হলাম আমার প্রতি তাদের হীনতা, অবজ্ঞার ভেতরেও আমি ভালবাসা খুঁজে পেতাম। মায়ের আসল রূপ ধরা পড়ে বাবা মারা যাওয়ার পর। তখন বোঝার বয়স আমার হয়েছে। পরিবারের নগন্য সদস্য ছিলাম আমি। মায়ের ঘৃণা, ভাই বোনের তিরষ্কার আমাকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিল। ফেলে আসা অতীতগুলো সব স্বপ্ন মনে হলো। সম্পত্তির লোভ মাকে এতই পেয়ে বসেছিল যে, আমার ভালবাসা তাদের ছলনা মনে হল। আমাকে এই আশ্রমে রেখে চলে গেল সবাই। আমি নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে ছিলাম। মা একবারও ফিরে তাকালো না পেছনে। এত ঘৃণা আমার প্রতি মায়ের? নিজেকে প্রশ্ন করলাম। সব জেনেও মাকে ঘৃণা করতে পারছিলাম না কিছুতেই। কেন জানি না, উল্টো মায়ের প্রতি ভালবাসা ও তাকে কাছে পাওয়ার আশা দিন দিন বেড়েই চলছিল।

এভাবে আশ্রমে কেটে গেল ১৬টি বছর। এই ১৬ বছরে প্রতিদিনই আমি গেটের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ভাবতাম মা আসবে। একটু হয়তো দেরী হচ্ছে। কিন্তু আসবে। মায়ের দেখা মিলেনি একবারও। তবে আশা আমি ছাড়িনি। বয়স এখন ৩৭-এর কোঠায়। একটি এনজিওতে চাকরি করছি। বিয়ে করিনি কারণ তেমন ইচ্ছে আমার ছিল না কখনোই। রানু ও প্রাপ্তির বিয়ে হয়েছে। রানুর দু’টি ছেলে। সবুজ লন্ডনে থাকে। পড়াশুনাও করেছে ওখানে। শুনে খুব ভাল লাগল। মায়ের আশা পূরণ হয়েছে। তার সন্তানেরা মানুষের মত মানুষ হয়েছে। রাজীব আমার বন্ধু। সে আবার প্রাপ্তির শশুড়বাড়ীর আত্মীয়। তার থেকে যত সব খবর পাওয়া। রাজীব বহু কষ্টে মায়ের ঠিকানাটা আমাকে এনে দিয়েছিল। ঠিকানাটা হাতে পাওয়ার পর মাকে আর দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। তবে আমিই অনেক কষ্টে রাজীবকে ঠিকানাটা এনে দিতে রাজি করিয়েছি। কিন্তু ঠিকানাটা পড়েই দেখিনি। হাতে কাগজটা নিয়েই ছিঁড়ে ফেলে দিলাম। এত বছরে এই প্রথম মাকে ঘৃণা হচ্ছে। “মা, একবারও কি আমার কথা মনে পড়লো না তোমার? হয়তো আমাকে তুমি জন্ম দাওনি তবে তোমাকে আমি মা বলে ডেকেছি। তোমাকে কাছে পাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত আমার জন্মদাত্রী মায়ের কথা একবারও মনে পড়েনি। যতবারই মা’র কথা চিন্তা করেছি, শুধু তোমাকেই সামনে দেখেছি। আর শুধু তোমার জন্য দু’চোখ জলে ভাসিয়েছি।” রাজীবের সামনে যখন এসব কথা বলছিলাম, তখন দেখি সে কাঁদছিল তবে আমার মোটেও কষ্ট হচ্ছিল না। আসলে আমার কিছুই অনুভব হচ্ছিল না। শুধু বাবাকে মনে পড়ছিল। আজ যদি বাবা থাকত তবে হয়তো আমার জীবনটা এমন হতো না। আমার চারপাশে আপন বলতে কেউ ছিল না। বন্ধু হিসেবে হাত বাড়িয়েছিল রাজীব। জীবনে এই একটাই ভাল বন্ধু পেয়েছি। তার বৌটাও বেশ ভাল ছিল, নাম নীলা। আমাকে বড় বোনের মত শ্রদ্ধা করত। রাজীব ও নীলার বিয়ের পরপরই বন্ধুত্বের গভীরতা অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। তখন দেখা হত হঠাৎ। আমি মাঝখানে ভীষণ বিষন্নতায় ভুগছিলাম। নিজের বেঁচে থাকার কোন কারণ বা ল্য খুঁজে পাচ্ছিলাম না, তাই নিজের অস্তিত্বকে মিটিয়ে দেব ভেবেছিলাম। কিন্তু তখনই আমার কাছে আসে অর্পিতা, রাজীব আর নীলার মেয়ে। অর্পিতার যখন ৩ বছর বয়স, রাজীব ও নীলা কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। নীলা মৃত্যুর আগে অর্পিতাকে আমার হাতে তুলে দেয়। সেই থেকে নতুন জীবন আমার। আমি মা হয়েছি।  পৃথিবীতে বেঁচে থাকার এক নতুন উদ্যম খুঁজে পেলাম। মা ও মেয়ের সুখের সংসার। আজ অর্পিতার জন্মদিন। ওর বয়স এখন ১২। ঠিক করেছি তাকে আজ বলব তার আসল মা বাবার কথা। কিভাবে নেবে সে, তা জানি না। তবে আমার বিশ্বাস আমার ভালবাসা তাকে আমার কাছ থেকে কখনোই দূরে নিতে পারবে না। বরং আমার আরো অনেক কাছে টেনে আনবে। তবে আবার ভয় হয়, আমাকে সে ভুল বুঝবে না তো? “অর্পিতা, মা হারানোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পেরেছি তবে সন্তান হারানোর কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না। জন্ম হয়তো আমি তোমাকে দেইনি। তবে ভালবাসায় বিন্দুমাত্র কৃত্রিমতা আমার না ছিল, না আছে, না থাকবে। আজ তোমার জন্মদিনে তোমাকে সব জানাবো। উপহার হিসেবে দেব তোমার মা আর বাবার ছবি। আর ১ ঘন্টা পরে তুমি ঘুম থেকে উঠবে। আমি সে সময়ের অপোয়, কখন তুমি উঠবে আর তোমাকে জড়িয়ে ধরব। আজকের সকালটা কেমন হবে কে জানে? আজ কি আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যাবে নাকি সোনালী রোদে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠবে? আজ প্রকৃতিও তোমার অপোয়। সে সাজবে তোমার রঙে। তোমার প্রতিটা ণ যেন শুভ হয় আর ভোরের আলোর মত স্নিগ্ধ থাকে সেই প্রচেষ্টায় থাকব সারা জীবন। “শুভ জন্মদিন মেয়ে”।

No comments:

Post a Comment

পাঠক সংখ্যা

free counters