হারায়ে খুঁজি

গ ল্প

মিথিলা জান্নাত


স্কুলে আজ বাংলা টিচার ছাত্র-ছাত্রীদের স্বপ্ন ও ইচ্ছা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। সবাই যে যার স্বপ্ন ও ইচ্ছা সম্পর্কে বলল। টিচার যখন আমার কাছে জানতে চাইলেন, তখন আমি বললাম, আমার স্বপ্ন হলো আমার মা ও বাবা দু’জনের আদর একসাথে পাওয়া। আমার স্বপ্নের কথা শুনে সবাই হেসে উঠল। টিচার অবাক হয়ে কিছুণ তাকিয়ে রইলেন। জানতে চাইলেন আমার এমন অদ্ভূত ইচ্ছের কারণ সম্পর্কে। আমি এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। কারণ আমার এই ইচ্ছের পেছনে এমন এক ঘটনা আছে যা কেউ জানে না। কিন্তু আজ তাদেরকে এ বিষয়ে বলতে হবে। কিভাবে বলব আমি? আমি কি পারব সবার সামনে আমার অবস্থা তুলে ধরতে? জানি না। শুধু এটুকু জানি আমি চেষ্টা করব।

আমি আমার মা বাবার একমাত্র সন্তান। ছোটবেলা থেকেই আমি মা বাবাকে কখনো কাছে পাইনি। কারণ তারা দু’জনই ভীষণ ব্যস্ত। তাদের কাছে সন্তানের চেয়েও বড় হল তাদের ক্যারিয়ার। আমার ছেলেবেলা কেটেছে বাসায় বন্দী অবস্থায়। সকাল হলেই মা বাবা তাদের বিশ্বস্ত বুয়ার হাতে আমাকে রেখে তাদের অফিসে চলে যেতেন। সব সময় তাদের কি সব মিটিং থাকত। মাঝে মাঝে থাকত বিভিন্ন পার্টি। তাই তারা ঘরে ফিরতেন অনেক রাতে। সে সময় আমি হারিয়ে যেতাম ঘুমের রাজ্যে। আবার খুব সকালে তারা কাজে চলে যাওয়ায় তাদের সাথে আমার দেখা হত না। এমনকি ছুটির দিনও আমার জন্য তাদের কোন অবসর ছিল না। চার দেয়ালের মাঝে বন্দি হয়ে বড় হতে লাগলাম আমি। সবাই যখন তাদের মা বাবার হাত ধরে স্কুলে যায়, তখন আমি যেতাম আমার বুয়ার হাত ধরে। স্কুল ছুটি হলে সবাই যখন মাকে সারাদিন কি ঘটল তার বর্ণনা দিতে দিতে বাড়ি ফেরে, তখন আমি বুয়ার হাত ধরে চুপচাপ বাড়ি ফিরতাম। আমার স্কুলে প্যারেন্টস্ ডে’তে
অনেক বড় অনুষ্ঠান হত। সবাই তাদের মা বাবাকে নিয়ে আসত। কিন্তু আমি সেদিন স্কুলে যেতাম না। কারণ আমার মা বাবার ব্যস্ততা।

এভাবেই দিন কাটছিল আমার। কিন্তু একদিন ঘটে গেল অন্য এক ঘটনা। রাতে হঠাৎ একটি শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি মা বাবা দু’জনই ঝগড়া করছে। ভীষণ সিরিয়াসভাবেই তারা ঝগড়া করছে। কিছু বুঝতে পারলাম না আমি। পরদিন সকালে মা বাবা একসাথে কোথায় যেন গেল। দুপুরে তারা কেউ বাসায় আসল না। সেদিন বিকেলে আমার একমাত্র ফুপী বাসায় এসে আমাকে তার কাছে নিয়ে গেলেন। দেখলাম আমার ফুপীর বাসায় চাচারা অনেকেই আছেন। আমার মনে হল আমাকে দেখে তাদের মন করুণায় ভরে গেল। দাদু আমাকে জড়িয়ে ধরে অনেকণ কাঁদলেন। পরে আমাকে শোনান হল যে, আমার মা বাবা আর কখনো একসাথে থাকবেন না। কারণ তাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। তখন আমার তেমন কোন ফিলিংস হলো না। মনে হলো মা বাবার আদর তো আমি এমনিতেই পাই না। কিন্তু পরে আমাকে নিয়ে তাদের অনেক সমস্যা হলো। আমি কার কাছে থাকব এটা নিয়েই সমস্যা। 

এক সপ্তাহ পর আমার মা বাবার সাথে আমার দেখা হলো আদালতে। তারা দু’জনই আমাকে কাছে রাখতে চান। বিচারক যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কার কাছে থাকব তখন আমি কোন উত্তর দিতে পারিনি। কারণ তাদের দু’জনকেই যে আমার ভীষণ প্রয়োজন। কিভাবে যেন আদালতের রায় হলো আমি মায়ের কাছে থাকব। কিছুদিন আমি তার কাছে থাকলাম। প্রায় এক বছর পর আমার নানা নানু তাদের একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। আমি দেখলাম মা কিছুদিন কান্নাকাটি করে পরে রাজি হয়ে যায়। মায়ের নতুন স্বামী মাকে নিয়ে বিদেশ চলে যায়। রেখে যায় আমাকে। এর কিছু দিন পর রোড অ্যাক্সিডেন্টে নানা নানু মারা যায়। এরপর আমি এলাম বাবার কাছে। কিন্তু বাবাও আবার বিয়ে করেছেন। নতুন মা আমাকে তার কাছে রাখতে রাজী নন। পুরোপুরি একা হয়ে যাই আমি।

পরবর্তীতে আমাকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেন আমার নিঃসন্তান চাচা চাচী। তারাই এখন আমার বাবা মা। নতুন বাবা মা আমাকে অনেক বেশি আদর করেন। না চাইতেই এখন অনেক কিছু পাই আমি। কিন্তু তারপরও আমার মন খোঁজে অন্য কিছু। কোনদিন যদি আমার সত্যিকার মা বাবা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন তবেই হয়তো আমি সব কষ্ট ভুলে যেতে পারব। সব কিছু হারাবার পরও আমি এখনও তাদেরকেই খুঁজি। সবসময় খুঁজি। 

No comments:

Post a Comment

পাঠক সংখ্যা

free counters