অনেতিহাসের গল্প

গ ল্প
শাফাক বিন নুর

ঈশ্বরের উপর বিশ্বাসটা আমার বরাবরই নড়বড়ে ছিল। কারণটা জানার চেষ্টাও কোন সময় করিনি। কোন পিছুটান না থাকায় সব কিছু করতাম ইচ্ছে মত। কেউ কখনো একটু ডাক দিয়েও বলেনি, “ওটা করো, এটা করো না।” তাই আস্তে আস্তে সবার প্রতি আমার ঘৃণা বাড়ছিল। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল আমার হতাশা। নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি। উত্তর পাইনি। পরে বুঝেছি মনের দুয়ার বন্ধ রেখে কোন প্রশ্নের উত্তর পাওয়া আসলেই অসম্ভব। এরপর আরো, আরো  ভেবেছি। বুঝেছি ঈশ্বরকে বাদ দিয়ে নিজের অস্তিত্বের আসলেই কোন ভিত্তি থাকে না। শেষ সময়গুলোতে কেন জানি অতীতের এই সব কথাগুলো খুব বেশি মনে পড়ছে। শেষ সময় বলছি কারণ জনমানবহীন, প্রাণহীন কোন মরুপ্রান্তরে পড়ে থাকা নিঃসঙ্গ একজন মানুষ, যে গত চব্বিশ ঘন্টা যাবৎ বাকশক্তিহীন, স্রেফ অনুভূতিশক্তি দিয়ে সে আর কতণ টিকে থাকতে পারবে? যাই হোক, যখন থেকে ঈশ্বরকে বিশ্বাস করেছি, তখন থেকেই মনে জন্ম হয়েছে এক অপার্থিব অনুভূতির। আমি জানি না এর কারণ কি। না, এই অনুভূতিতে সুখ কিংবা দুঃখের কোন ব্যাপার নেই। আছে ভিন্ন কিছু। আচ্ছা, এটা কি ধরণের অনুভূতি? এই অনুভূতির দ্বারা একমাত্র মানুষ ছাড়া আর সবাইকে আমি ছুঁয়ে যেতে পেরেছি। মানুষকে আমি অনুভব করেছি, ভালোবেসেছি। কিন্তু মানুষ আমাকে ভালোবাসেনি, অনুভবও করেনি। সমগ্র মানব জাতির মূল্যায়নের মানদণ্ড যেন অর্থ-পুঁজি, মতা। আচ্ছা, এগুলোই কি জীবনের সবকিছু? জীবন তো এত ুদ্র না। তাহলে কেন জীবন এই সব জাগতিক চলকের হাতে বন্দী? হঠাৎই খেয়াল করলাম, মানুষ ছাড়া সমস্ত দুনিয়াই আমাকে ভালোবেসেছে। কিন্তু খেয়ালটা হলো অনেক পরে। নিজের কাছে নিজে আরো একবার হারলাম। দেখলাম দুনিয়া আমাকে তিরষ্কার না করে বরং কাছেই টেনে নিয়েছে। ভালোবেসেছে। আমাকে তারা কিছু একটা দিতে চেষ্টা করেছে...

ঈশ্বরের ইচ্ছাটা আমার কাছে সবসময়ই বড় বেশি রহস্যময় লেগেছে। তিনি আজ পর্যন্ত আমাকে সঙ্গীহীন, পরিবারহীন রেখেছেন। কেন? কেন তিনি আমাকে এমন এক সমাজের বাসিন্দা করেছেন, যেখানে যন্ত্রের মতো মানুষগুলো একজন  আরেকজনকে অনুভব করার, বুঝবার চেষ্টাটাও করে না? ...আচ্ছা, আমিও কি অবচেতন মনে কাউকে অবহেলা করেছি?

জীবনের শুরু থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত একাকীত্বকে আমি অনুভব করেছি, ঘৃণা করেছি। একাকীত্বের যাতনা আমাকে তিলে তিলে গ্রাস করেছে। আমার সমাজ ব্যবস্থার প্রতিও আমি কখনোই কোন দুর্বলতা অনুভব করিনি। কেনই বা করবো? যে সমাজ মানুষকে স্বাভাবিকতা, মৌলিকতা আর মানবিকতার শিক্ষা দেয় না, সে সমাজের প্রতি আবার কিসের দুর্বলতা? তাই বহুদিন থেকেই জনমানবহীন কোন প্রান্তরে এক মানববসতি পত্তনের অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি, যে সমাজ হবে আমার একার সৃষ্টি। যেখানে থাকবে না কোন নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা। থাকবে সহমর্মিতা আর ভালোবাসা...

যখন থেকে ঈশ্বরকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেছি, আমার সকল কাজে তখন থেকেই তাঁর নীরব উপস্থিতির ছোঁয়া পেয়েছি। তবে এগুলোকে কোন সময় ব্যাখ্যা করতে চেষ্টাও করিনি। সমাজের প্রতি আকর্ষণ দিনে দিনে কমতে লাগলো আর সবার থেকে আলাদা হয়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার আকক্সাও তীব্র হতে লাগলো, যেখানে এই সমাজের কোন কিছুই আমাকে স্পর্শ করবে না। মনের ভেতরে কাদের ডাক শুনতে পেতাম প্রতিনিয়ত, মনে হতো আমার স্বপ্নে দেখা সমাজের বাসিন্দারা আমাকে ডাকছে। এক সময় দরজার বাইরে পা রাখলাম। শুনলাম জানালার ওপাশ থেকে প্রিয় কণ্ঠের সুর বাজছে। আমি হতচকিত, মোহগ্রস্থ হয়ে গেলাম। আর এদিকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার স্বপ্ন। কেন এমন হয়? এক পা ঘরের বাইরে অন্য পা ভেতরে দিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। এটাই কি আমার নিয়তি?...আমি বেরিয়ে পড়লাম। পেছনে পড়ে থাকলো সবকিছু...

এখন আমি যেখানটায় আছি, এটি বসবাসের জন্য সম্পূর্ণ অনুপযোগী একটি জায়গা। এই জায়গাকে তার বিপরীত অবস্থায় নেওয়ার জন্য আমি আমার জীবনের সবচাইতে কঠিন পরিশ্রম করেছি। আমি রাতদিন  কাজ করি আর অন্যদিকে আমার সমস্ত সঞ্চয় দিনে দিনে কমতে থাকে। এক সময় সমস্ত খাবার, পানি ফুরিয়ে গেলো। ধীরে ধীরে দুর্বল হতে লাগলাম। ুধায় পিপাসায় কাতর আমি এই মরুভূমির কোথাও পাইনি এক ফোটা পানি। ঈশ্বরের দয়া কি আর আসবে না, যেভাবে ধর্মগ্রন্থগুলোতে বর্ণিত হয়েছিল? আমার প্রাথমিক কাজ আমি শেষ করেছি। শুধু দরকার সামান্য বৃষ্টির। জানি আমার এই চাওয়াটা অবান্তর, কিন্তু এটা তো  অসম্ভব না। ুধা পিপাসা আর বৃষ্টির অপোয় কাতর আমি যখন বাকশক্তিহীন হলাম, তখন দেখলাম ধুলো-বালিরা আমার মনের কথা শুনছে। তাদের কাছেই বললাম আমার না বলা কথা। এখন হঠাৎ করেই কেমন জানি লাগছে। নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। চোখের সামনে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসছে। আমি কি মারা যাচ্ছি? নাকি নতুন কোন জীবনে প্রবেশ করছি?

পরিশিষ্ট
হ্যাঁ, তিনি মারা গেছেন। ঈশ্বর এখানেও তাঁর রহস্যময় আচরণকে ধরে রেখেছেন, যে আচরণ বরাবরের মতোই ব্যাখ্যাতীত। মানুষটির মৃত্যুর পরে মরুভূমিতে সৃষ্টি হলো প্রচণ্ড মরুঝড়ের। ধূলো-বালিতে ঢাকা পড়লো তার লাশ। কিছুদিন পরে হঠাৎ প্রচণ্ড বৃষ্টিতে সিক্ত হলো রু মরুভূমির শুষ্ক প্রান্তর। সেই প্রাকৃতিক কবরের উপর জন্মালো মরুভূমির প্রথম গাছ। এরপর আরেকটি, তৃতীয়টি, চতুর্থটি...। কালের পরিক্রমায় মরুভূমিটি রূপান্তরিত হলো বনভূমিতে। সেখানে আশ্রয় নিল নাম না জানা অসংখ্য পাখি। এরপর কোন একদিন এক যাযাবর দল বনভূমির কোল ঘেঁষে বসতি গড়লো।

...আচ্ছা তাদের স্থায়ী বসতিটি কি সেই স্বপ্নদ্রষ্টার স্বপ্নের মতই হয়েছিল? না, এই প্রশ্নের জবাবের কোন দরকার নেই। একজন মানুষের সব স্বপ্ন পূরণ হতেই হবে এমন কোন কথা তো নেই।

4 comments:

  1. ami ei lekhata tomar dea boi a porechi. Khub valo hoeche.cTumar modhdhe ei dhoroner feelings kaz kore age buzhini. Khub shundar gochano ebong heart touched lekha.

    ReplyDelete
  2. শাফাক, খুব ভালো লাগলো। কিন্তু অনেতিহাস কী? মানেটা একটু আন্দাজ করা যায়, কিন্তু অনেতিহাস বলে কি আসলেই কোনো শব্দ আছে?

    ---ইউসুফ ইমরান

    ReplyDelete
  3. সালমান, অভ্র সেটআপ করে নাও। বাংলা লেখ।

    ReplyDelete
  4. আপনার লেখাটা ভালো লাগল আমি নিজেও এখানে লিখতে চাই।

    ReplyDelete

পাঠক সংখ্যা

free counters